পাকিস্তান সরকারের বাঙালি জাতির পরাধীনতার বিষয় টি আমরা অনেকেই জানি। আমাদের মাতৃভাষা বাংলাকে পদাঘাত করে উর্দুকে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষা করবার বিরুদ্ধে সচেতন বাঙালিরা আন্দোলন -সংগ্রাম করে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি বাঙালির জীবনে ঐতিহাসিক প্রাণের দাবি বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্র ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি আদায় করেছিল। সেকথা আজ আমরা সবাই জানি ও প্রতিবছর পালন করি নানান আয়োজনে।
প্রসঙ্গক্রমে আমরা প্রায়শই দুই বাংলা কথাটি বার বার বাঙালি শিল্প সংস্কৃতি ক্ষেত্রে ব্যবহার করি। সেক্ষত্রে ভারতের পশ্চিম বাংলা আর বাংলাদেশ বুঝাই। কিন্তু যাতায়াত যোগাযোগ নিয়মিত না থাকায় অনেকেই আসাম ত্রিপুরা, উড়িষ্যা রাজ্যের বাংলা ভাষার বাঙালি সংস্কৃতির ইতিহাস জানিনা বিধায় ঐ রাজ্যের সাথে অনেকেই অপরিচিত। আমি মাতৃভাষা প্রনাম দিবসে বাংলাদেশের পক্ষে সরকারি আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে গত ১৯৯৭ সালে ত্রিপুরা রাজ্যের ধর্মনগরে সরকারি অনুষ্ঠানে যোগদানের মাধ্যমে জীবনের নব দিগন্তের সন্ধান পেয়েছি। শিক্ষা ও সংস্কৃতি মন্ত্রী প্রধান অতিথি ছিলেন, আমি সহ ভারতের কয়েকজন বিশেষ অতিথি ছিলাম। ঐ অনুষ্ঠানে সম্মাননাও পেয়েছিলাম সম্মানী সহ। যেখানে সম্পূর্ণ ষোলআনা নিখাদ বাঙালি সংস্কৃতির চর্চা হয়। তাদের শ্লোগান ছিল নিজের ভাষাকে ভালবাসবো অন্য ভাষাকে শ্রদ্ধা জানাবো। এত সুন্দর বাঙালি সংস্কৃতির অনুষ্ঠান পশ্চিম বাংলা ও বাংলাদেশের কোন অনুুষ্ঠানেও নজরে পড়েনি। যারা চট্টগ্রাম, সিলেট, মৌলভীবাজার এলাকায় শিল্প সংস্কৃতির সঙ্গে জড়িত তারা মাঝে মধ্যেই তাদের অনুষ্ঠানে যোগদানের মাধ্যমে দেখেছেন। কিন্তু দুর্ভাগ্য ওরা আজও আমাদের কাছে অজানাই রয়ে গেছে।
আমরা বাঙালিরা মাতৃভাষা দিবস হিসেবে শুধু ২১ শে ফেব্রুয়ারি পালন করি। কিন্তু মাতৃভাষা বাংলাকে প্রতিষ্ঠার জন্য আসামের শিলচরে যে ১১ জন শহীদ অসমীয়া ভাষার বিরুদ্ধে বাংলা ভাষা প্রতিষ্্ঠার জন্য আত্মবলিদান দিয়েছিল তাদেরকে আমরা স্মরণ করিনা। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের মাঝেও শ্রদ্ধা জানাই না। বাংলাদেশের বাঙালিরা ১৯ মে তো পালনই করিনা। কিন্তু সবার জ্ঞাতার্থে ছোট্ট পরিসরে আজ আমি সেই ইতিহাস প্রকৃৃত বাঙালি সংস্কৃতির ধারক বাহকদের তথা বাংলাদেশের বাঙালিদের উদেশ্যে কিছুটা তুুলে ধরছি।
আমাদের প্রতিটি দেশপ্রমিক ও মাতৃভাষা অনরাগী বাঙালিদের অবশ্যই কর্তব্য ও দায়িত্ব৫২র সুত্র ধরে বাংলাদেশের ৯জন বাঙালি সহ ১৯৬১ সালের ১৯ মে বাংলা ভাষার জন্য আত্মবলিদান কৃত ১১ জন বাঙালির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করে শহীদদের প্রতি যথাযথভাবে সম্মান ও তাদের আত্মত্যাগের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা। সেই সাথে অনুরোধ জানাই যারা এখনও ত্রিপুরা বা আাসাম বেড়াতে জাননি তারা এখবার হলেও ঘুরে সচক্ষে অবলোকন করে আসুন। দেখবেন দৃষ্টি ভঙ্গি বদলে আপনার শ্রদ্ধা বোধ বেড়ে যাবে। পরীক্ষা প্রার্থনীয়।।
১৯৬১ সালের মহান উনিশে মে আসাম, ত্রিপুরা সহ পশ্চিমবঙ্গে কিছুটা পালিত হয় ঐতিহাসিক ভাষা দিবস । বাংলা ভাষার জন্য আত্মবলিদান দিবস বা বাংলা ভাষা শহীদ দিবস । আজ থেকে ষাট বছর আগে রবীন্দ্র জন্মশতবর্ষে উনিশশো একষট্টি সালের উনিশে মে ভারতের অসম রাজ্যের বরাক উপত্যকার শিলচরে বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষা করতে গিয়ে এগারো জন দেশপ্রেমিক বাঙালি যুবক যুবতী পুলিশের গুলিতে মৃত্যু বরণ করে শহীদ হয়েছিলেন । এর মধ্যে মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী ষোলো বছরের কমলা ভট্টাচার্যও ছিলেন । যিনি পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম মহিলা ভাষা শহীদ । এছাড়াও যাঁরা সেদিন মহান একুশে ফেব্রুয়ারির চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে মাতৃভাষা বাংলাকে রক্ষা করার জন্য বুকের সবটুকু রক্ত শিলচর রেল স্টেশন চত্বরে রাজপথে ঢেলে দিয়েছিলেন তাঁরা হলেন চন্ডীচরণ সূত্রধর, শচীন্দ্র চন্দ্র পাল, সুনীল কুমার সরকার, বীরেন্দ্র সূত্রধর, কানাইলাল নিয়োগী, সুকোমল পুরকায়স্থ, সত্যেন্দ্র দেব, হীতেশ বিশ্বাস, কুমুদ রঞ্জন দাস এবং তরণী দেবনাথ।
সমগ্র বাঙালি ভারতীয় বাংলা টিভি চ্যানেলগুলোর সিরিয়ালের প্রতি আসক্ত। আমরা লক্ষ্য করি ভারতীয় বাঙালি ধর্মীয়, সামাজিক, সাহিত্য, সংস্কৃতি কৃষ্টিগুলো প্রতিটি সিরিয়ালের কাহিনীচিত্রে তুলে ধরা হয়। অথচ অত্যন্ত দুঃখের বিষয় বাংলা সংস্কৃতির ইতিহাস ঐতিহ্য নিয়ে যারা ব্যবসায়িক ফায়দা লুটছেন তারাও আত্মত্যাগী ঐ অমর ভাষা শহীদ ১১ জনের নূন্যতম শ্রদ্ধা নিবেদন করে ১৯ মে কে মাতৃভাষা প্রনাম দিবসটিকে সমগ্র বাঙালি পরিমন্ডলে তুলে ধরছেন না। ভারত বহু ভাষাভাষির দেশ, সেখানে রাষ্ট্রীয়ভাবে বাংলা ভাষা দিবস পালন এর আন্দোলন সহজ নয় তবে বাঙালি অধ্যুষিত ও বাংলা শিল্প সংস্কৃতি কেন্দ্রীক প্রতিষ্ঠানগুলো অবশ্যই যথাযোগ্য সম্মানের সাথে মাতৃভাষা প্রনাম দিবসটি পালন করতে পারেন। যাঁরা দিয়ে গেছে মাতৃভাষা বাংলার জন্য প্রাণ, তাঁরা প্রতিদানের জন্য আত্মবলিদান দেননি। বাংলা প্রতিষ্ঠা পেয়েছে বলেই আমরা বাংলা শিল্প সংস্কৃতিকে লালন পালন করে প্রাণ খুলে বাংলা ভাষাকে ব্যবহার করতে পারছি। তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধা ও সম্মান জানানো আমাদের সমগ্র বাঙালি জাতির মানবিক দায়বদ্ধতা এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে ইতিহাস জ্ঞাত করাটা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব ও কর্তব্য। আশা করবো আগাামী বছর থেকে ভারতীয় বিশেষত বাঙালি সংবাদপত্র, টিভি চ্যানেল সহ সকল সংবাদ মাধ্যম বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে প্রচার করতে আন্তরিক হবেন।
পরিশেষে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি নিবেদন বাংলা মাতৃভাষার আন্দোলনের সূত্র ধরেই মাতৃভূমি স্বাধীকার আন্দোলন ও ৭১ এর ১৬ ডিসেম্বর বিজয় অর্জন। বাংলা মাতৃভাষার জন্য আত্মত্যাগ পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল দৃষ্টান্ত, যার গৌরবে আমরা পেয়েছি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষার সম্মান। বিশ^ব্যাপী পালিত হয় এই দিবসটি। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় মাতৃভাষা বাংলার জন্য ৫২’র চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে ১৯৬১ সালে অসমীয়া ভাষার বিরুদ্ধে বাংলাকে প্রতিষ্ঠা করতে যাঁরা আত্মবলিদান করেছিল সেই এগারোজন ভাষা শহীদের মধ্যে নয় জনেরই জন্ম তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের হবিগঞ্জ, সিলেট, মৌলভীবাজার, ময়মনসিংহ এবং ঢাকায় (অর্থাৎ আমাদের আজকের স্বাধীন বাংলাদেশের সূর্য সন্তান তারা)। অথচ বাংলার ইতিহাসে পাঠ্য পুস্তকে কোথাও তাদের নাম ও ইতিহাস স্থান পায়নি যা অত্যন্ত দুঃখজনক। বিশ^মাঝে আমরা গর্বিতজাতি, যাদের রাজনৈতিক মতাদর্শ ভিন্ন হলেও মাতৃভাষা বাংলা নিয়ে কোন বিরোধ নেই। আমরা বাঙালি হয়ে বাংলা ভাষার জন্য আত্মত্যাগী বাঙালিদের প্রতি সম্মান প্রদর্শনে কেন উদাসীন বা অনিহা প্রকাশ করছি সচেতন বাঙালি হিসেবে এটাই আশ্চর্যজনক লাগে। অসংখ্য বাঙালি এই ইতিহাস আজও জানেই না, কিন্তু কেন এই বৈরীতা? আসুন আমরা সবাই এই বাঙালি ও বাংলা ভাষার অমর অমর শহীদদের নাম ভাষা সৈনিকদের তালিকায় সম্পৃক্ত করতে ও প্রতি বছর ১৯ মে বাংলা ভাষা বিজয় দিবস হিসেবে রাষ্ট্রীয়ভাবে পালনের দাবি জানাই ও প্রত্যেকেই আমাদের নিজেদের বাড়িতে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে এগারোটি প্রদীপ প্রজ্বলন করি । আমরা বাঙালি সংস্কৃতিবানরা আন্তরিক ও <