উদ্যানবিদ রবীন্দ্রনাথ কীভাবে আমাকে উদ্বুদ্ধ করেন : ড. কল্যাণ চক্রবর্তী
1 min read
রবীন্দ্র-প্রতিভা বহুমুখী। ঈশ্বরের কাব্য প্রকৃতি, তা যে কবিগুরুকে আকর্ষণ করবে — এ তো কোনো আশ্চর্যের কথা নয়! তাই রবীন্দ্র সাহিত্যে ও জীবনচর্যায় দেখি প্রকৃতি-প্রেমের নানান মাত্রা। শুধু প্রকৃতি-চিত্রণ নয়, প্রকৃতি সংরক্ষণ এবং প্রকৃতিকে নিয়ে গবেষণা করার একাধিক দৃষ্টান্ত চোখে পড়ে তাঁর সৃষ্টিতে। প্রকৃতির প্রতি রবীন্দ্র-বীক্ষণের একটি দিক হল তাঁর উদ্যান চেতনা।
কৃষির উন্নতিতে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ব্যবহার করার রবীন্দ্র-মানস আমাকে উদ্বুদ্ধ করে। তাঁর হাতে-কলমে কৃষিশিক্ষা ও আদর্শ গ্রাম তৈরির পরিকল্পনায় আমি অভিভূত হই। ১৯০৬ সালে রবীন্দ্রনাথ পুত্র রথীন্দ্রনাথকে আমেরিকার ইলিনয় বিশ্ববিদ্যালয়ে কৃষিবিজ্ঞান পড়তে পাঠিয়েছিলেন।
তাঁর শান্তিনিকেতন পরিকল্পনা অসাধারণ। রুক্ষ জমিকে সবুজ করার পরিকল্পনা অবশ্যই আনন্দদায়ক। শান্তিনিকেতন শ্রীময়ী রূপ পেয়েছে রবীন্দ্রনাথের জন্য। ১৯২১ সালে কৃষিবিজ্ঞানী এলমহার্স্টের সহযোগিতায় সরুল গ্রামে তিনি স্কুল অফ এগ্রিকালচারের কাজ শুরু করেন। কৃষির প্রতি কবির মনোযোগ আমাকে কৃষি বিজ্ঞান পড়তে উৎসাহ যুগিয়েছিল।
রবীন্দ্রনাথ অজস্র বিদেশী উদ্ভিদের বাংলা নামকরণ করেছিলেন। নীলফুলের লতা পেট্রিয়া ভলুবিলিস-কে ডাকলেন নীলমণি লতা বলে। সাদা ফুলের বৃহৎ বৃক্ষ মিলিংটোনিয়া হরটেনসিসের নাম দিলেন হিমঝুরি। কুইসকোয়ালিস ইণ্ডিকার নাম হল মধুমালতী। গ্লোরিওসা সুপারবা-কে অগ্নিশিখা নামে জনপ্রিয় করলেন।
বিশ্বভারতীর সদ্য-স্নাতকবৃন্দ সমাবর্তনে কবির কাছ থেকে ছাতিম শাখার অভিজ্ঞান লাভ করছেন — এ জাস্ট ভাবাই যায় না! গাছের সবুজ-শ্যামলিমা, রবীন্দ্রনাথের মতোই চিরনূতন। বনস্পতির বৃহৎ গুঁড়ির মতোই তিনি সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রতি দায়িত্বশীল। শ্যামলতনুর লতাকুঞ্জের মতোই তিনি স্নেহপ্রবণ শিক্ষাবিদ।আমার জীবনের পরতে পরতে, চেতনায়-তন্দ্রায়-বোধে রয়েছেন তিনি — রবীন্দ্রনাথ।
রবীন্দ্র সাহিত্য আমাকে গাছের ছায়ার মতোই কর্মব্যস্ততার রোদ্দুরে ছায়া দেয়। রবীন্দ্রনাথের ‘মালঞ্চ’ উপন্যাসটি পড়ে সিদ্ধান্ত নিলাম হর্টিকালচার হবে আমার উচ্চশিক্ষার বিষয়। ১৯৩৪ সালে তিনি লিখেছিলেন মনস্তাত্ত্বিক এই ত্রিকোণ প্রেমের কাহিনী ‘মালঞ্চ’, তার কেন্দ্রীয় চরিত্র একটি কুসুমোদ্যান — তাতে অসংখ্য দেশী-বিদেশী ফুলের সৌকর্য। উপন্যাসের নামকরণ, উদ্যান পরিকল্পনা, বাগিচা-রচনা, পুষ্প সম্ভারের বিপণন — সব কিছুর মধ্যেই তাঁর অনন্য বক্তব্য আমাকে মুগ্ধ করেছে। মালঞ্চের প্রেক্ষাপটে ঘটে চলেছে একের পর এক কাহিনী — আদিত্য, নীরজা ও সরলার আন্তঃসম্পর্ক।
কী আলোচনা নেই সেই উপন্যাসে? ফর্ণারী, ছিঁটেবেড়া দিয়ে তৈরি অর্কিড হাউস — তাতে অপরাজিতার লতা, রোজারি, লন, সীড-বেড বা কেয়ারী, পুরোনো অর্কিড চিরে ভাগ করে নতুন অর্কিড তৈরির আলোচনা। কামিনী গাছের বেড়ায় Live fencing; সেলিবিস, জাভা, চীন থেকে অর্কিডের introduction; বাড়িভাঙার রাবিশ ব্যবহার করে মালচিং; পোড়া ঘাস-পাতা মাটিতে দিয়ে হাল্কা করে ঝুরো করা ইত্যাদি বিষয়ে আলোচনা রয়েছে।
রবীন্দ্রনাথের ‘রক্তকরবী’ নাটকটি পড়েই ফুলটিকে একান্তে ভালোবেসে ফেলেছি। ওটা আমার এক গোপন কথার মতোই, নিজের ফুল। কেজো জীবনের ফাঁকে কখনও ফুলটি দেখবার সুযোগ পেলে বাঁচার সুযোগ পাই। আমার দুঃখের ধন হয়ে ওঠে রক্তকরবী ফুল। রঙের তত্ত্বের চাইতেও রাঙা আলোর মশাল জ্বলে ওঠে যেন ফুলটি দেখলে। পড়াতে ইচ্ছে হয় রক্তকরবীর মালা।
‘গল্পগুচ্ছ’-র ‘বলাই’ গল্পটি পড়েও উদ্বোধিত হই — যেন জৈব বিবর্তনের গল্প। বলাই নামের ছেলেটির আসল বয়স যেন সেই কোটি কোটি বৎসর আগেকার দিনের। বলাই যেন গাছের মতোই, সূর্যের দিকে হাত তুলে বলে, “আমি থাকব, আমি বাঁচবো, আমি চির পথিক, মৃত্যুর পর মৃত্যুর মধ্য দিয়ে অন্তহীন প্রাণের বিকাশতীর্থে যাত্রা করব রৌদ্রে-বাদলে, দিনে-রাত্রে।” আমি থাকব, আমি থাকব — করোনা পরিস্থিতিতে এ সকল মানুষেরই ভাষা। সেই বিশ্বপ্রাণের বাণী রক্তের মধ্যে শুনতে পেয়েছিল বলাই।
‘গল্পসল্প’-র একটি গল্প ‘ধ্বংস’ আমাকে দারুণ ভাবে প্রভাবিত করেছিল উদ্যান পালনের প্রতি। যুদ্ধের প্রেক্ষিতে সেই গল্প; প্যারিস শহর থেকে অনতিদূরে একটি ফুলবাগান, নার্সারী। তার মালিক পিয়ের শোপ্যাঁ-র শখ ছিল গাছপালার জোড় মিলিয়ে, রেণু মিলিয়ে, তাদের চেহারা, তাদের রঙ, তাদের স্বাদবদল করে নতুন উদ্ভিদের জাত সৃষ্টি করা। এমন সময় এলো যুদ্ধ! জার্মানীর সঙ্গে ফ্রান্সের ঘোরতর যুদ্ধ। পিয়েরকে যেতে হল রণক্ষেত্রে, বাগানের ভার এসে পড়লো মেয়ে ক্যামিলের হাতে। বাগান তারও দিনরাতের আনন্দ, কাজকর্মের সঙ্গী। সে-ও হলদে রজনীগন্ধা তৈরি করে। ইতোমধ্যে যুদ্ধের সাফল্যে পিয়ের পেয়েছে সেনানায়কের তকমা। সুখবর দিতে আসেন তিনি মেয়েকে। আর সেদিন সকালেই গোলা এসে পড়ে ফুলবাগানে। প্রাণদান করেছিলো যে ক্যামিল, তার প্রাণসুদ্ধ নিয়ে ছারখার হয়ে গেল বাগান। রবীন্দ্রনাথ শেষ করেছেন এইভাবে, “এর মধ্যে দয়ার হাত ছিল এইটুকু, ক্যামিল ছিল না বেঁচে।” অর্থাৎ নিজের সৃষ্টি, নিজের রচনা কে-ই বা ধ্বংস দেখতে চায়? ক্যামেল তাই যুদ্ধের আবহে মরে বেঁচেছে, এটাই ঈশ্বরের দয়া। যুদ্ধ যে কতটা অযাচিত তা এই গল্প পড়ে আমি বুঝতে পেরেছিলাম। বুঝতে পেরেছিলাম, সবুজের সমারোহই আনন্দ, গাছই হল আমাদের ফুসফুস। এ সমস্ত বোধ আমায় দিয়েছেন ‘উদ্যানবিদ’ রবীন্দ্রনাথ।
( লেখক বিধানচন্দ্র কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও প্রাবন্ধিক) সংগৃহীত